এক নজরে
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিজ্ঞতার ও কর্মপরিধির দিক থেকে বিআরডিবি পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে একক বৃহত্তম সরকারি প্রতিষ্ঠান। ষাট এর দশকে প্রবর্তিত এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ‘কুমিল্লা মডেল’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি (আইআরডিপি) গ্রহণ করা হয়। পল্লী উন্নয়নে আইআরডিডিপ’র সফলতা, অবদান ও গুরুত্ব মূল্যায়ন করে ১৯৮২ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। আইআরডিপি’র মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ মাঝারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদেরকে সমবায় সমিতির আওতায় সংগঠিত করে কৃষি আধুনিকায়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়সম্পূর্ণতা অর্জন করা। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে মহিলা উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প/কার্যক্রম চালু করা হয়। আশি’র দশকের গোড়ার দিকে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি ও তাদের আর্থ-সামাজিক জীবন মানের উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে বিআরডিবি সরকারের পল্লী উন্নয়ন নীতি ও কৌশলের সাথে সংগতি রেখে পল্লীর ক্ষুদ্র ও সম্পদহীন দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে সমবায় সমিতি ও অনানুষ্ঠানিক দলের আওতায় সংগঠিত করে সমন্বিত পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য জনহিতকর কর্মসূচি আকারে সমবায় ব্যবস্থার প্রচলন করে। এর লক্ষ্যে ছিল অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের হাত থেকে গ্রামের দরিদ্র কৃষকদেরকে রক্ষা এবং মহাজনী ঋণের সুদের বোঝা থেকে তাদেরকে মুক্তি দেয়া। সে সময় মহাজনদের নিকট থেকে ঋণ পেতে বন্ধক দেয়ার একমাত্র সম্পদ ছিল জমি। ফলে ঋণগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা জমিতে প্রবেশের অধিকার হারিয়ে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষকদের এই অবস্থাকে বিবেচনায় এনে ১৮৯৫ সনে মাদ্রাজ প্রদেশের তদানীন্তন কালেক্টর নিকলসন সমবায় ভিত্তিক গ্রামীণ ব্যাংক বা ঋণদান ও সঞ্চয় সমিতি চালু করার জন্য তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের নিকট লিখিত প্রস্তাব প্রেরণ করলেন বৃটিশ সরকার ১৯০৪ সনের ২৫ মার্চ সমবায় ঋণদান সমিতি আইন পাশ করে। গ্রামীণ কৃষকদের জন্য ঋণ প্রবাহ সৃষ্টির এই ব্যবস্থা ১৯৪৭ সনে ভারত বিভাগের প্রভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের সদর দপ্তর কলকাতায় হওয়ায় তা ভারতের ভাগে চলে যায়। ফলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকরা ভীষণভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক ব্যাংক (বর্তমানে যা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থার সকল পদক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কেবল কৃষি ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করা। ফলে গ্রামীণ কৃষকদের জীবন-যাত্রার মানের অন্যান্য দিকগুলো বিবেচনায় আনার কোন অবকাশ ছিল না।
দেশের গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের এ সমস্যার সমাধানের জন্য একটি Multi-sectoral ব্যবস্থা খুঁজে বের করার জন্য গবেষকরা কাজ শুরু করেন। এই সমস্ত গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ষাট দশকের প্রথম ভাগে ড. আখতার হামিদ খাঁনের নেতৃত্বে কুমিল্লায় তদানীন্তন Pakistan Academy for Rural Development (বর্তমানে BARD) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ড. খাঁন তাঁর গবেষণায় পল্লী উন্নয়নের জন্য সমন্বিত মডেল প্রস্তাব করেন এবং তদানীন্তন BARD এর মাধ্যমে Piloting শুরু করেন যা পল্লী উন্নয়নে ‘কুমিল্লা মডেল’ নামে সুখ্যাত।
কুমিল্লা মডেলের ৪টি অঙ্গ
কুমিল্লা মডেলের ‘ভিশন’ ছিল যে, যতক্ষণ গ্রামগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে না পারছে, ততক্ষণ গ্রামীণ সমাজের ভেতর থেকে পরিবর্তনের কোন তাগিদ সৃষ্টি হবে না। সে লক্ষ্যেই কুমিল্লা মডেলের একটি অন্তর্নিহিত ভিশন ছিল গ্রাম পর্যায়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। গ্রাম ভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমেই সেটা করা সম্ভব হয়েছে যা আজ সর্বস্বীকৃত। কুমিল্লা মডেলের অঙ্গ চারটি হলো-
থানা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিডিসি)
পল্লী পূর্ত কর্মসূচি
থানা সেচ কর্মসূচি ও
দ্বি-স্তর সমবায় কাঠামো।
১৯৭০ সন পর্যন্ত পল্লী উন্নয়নে কুমিল্লা মডেল কুমিল্লা জেলার ২০টি থানা এবং জেলার বাইরে ৩টি থানায় Piloting করা হয়। ১৯৭১ সনে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের লক্ষ্যে কুমিল্লা মডেলের দ্বি-স্তর সমবায় কাঠামোকে জাতীয় পর্যায়ে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে হাতে নেয়া হয়। সেই থেকেই সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি অর্থাৎ আইআরডিপি’র যাত্রা শুরু।
১৯৭১ সনে যাত্রা শুরুর পর এর সফলতা লক্ষ্যে করে পল্লী উন্নয়ন কর্মকান্ড'কে আরও গতিশীল করার জন্য ১৯৭৩ সনে আইআরডিপি’কে ‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা’ নামে সরকারের একটি উন্নয়ন সংস্থায় রূপান্তর করা হয়। কিন্তু কুমিল্লা মডেলের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এবং আরও অধিকতর Piloting না করে কর্মসূচিটিকে সংস্থায় রূপান্তর করা সমীচীন হবে না মর্মে দাতাদের পরামর্শের ভিত্তিতে ১০ মাস পর বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন সংস্থা’র বিলুপ্তি ঘটিয়ে পুনরায় আইআরডিপি পুনর্বহাল করা হয়। আইআরডিপি কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের উপর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, সরকারি পর্যায়ে গৃহীত পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প/কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্বি-স্তর সমবায় ব্যবস্থাটি গ্রামীণ জনগণের জন্য হিতকর এবং ক্ষমতাশালী কৌশল হিসেবে কাজ করেছে, যা পল্লী উন্নয়নের একমাত্র পেটেন্ট হিসেবে দাবি করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশের উপর ভিত্তি করে আইআরডিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন কৌশল পরিবর্তন করে দারিদ্র্য বিমোচনমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে থাকে। সর্বোপরি এ সমীক্ষার সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ সালে আইআরডিপি’কে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বোর্ডে রূপান্তরিত করে যা বর্তমানে ‘‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি)’’
নামে পরিচিত।
সত্তরের দশকে ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান ‘পল্লী উন্নয়নে সোনালী সোপান’ হিসেবে বিআরডিবি’র অবদান আজ বহুল প্রশংসিত। সত্তরের দশকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি দ্বিগুন হওয়ার পিছনে বিআরডিবি’র অবদান সর্বজন স্বীকৃত। সে সময় বিআরডিবি বিভিন্ন ধরনের হস্তচালিত নলকূপ, গভীর নলকূপ কৃষকদের মাঝে বিতরণের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থা গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছে। সত্তর থেকে নববই দশকের শেষ পর্যন্ত সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিআরডিবি বিভিন্ন প্রকল্প/কর্মসূচিও গ্রহণ করে।
তৎপরবর্তীতে বিআরডিবি তার মূল কর্মকান্ড অর্থ্যাৎ দ্বি-স্তর সমবায়ের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বেশ কিছু বিশেষায়িত প্রকল্প সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করেছে; যেমন- মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচি(১৯৭৩), যুব উন্নয়ন কর্মসূচি (১৯৭৮), বিত্তহীন কর্মসূচি (১৯৮৪) ইত্যাদি। বিআরডিবি কর্তৃক বাস্তবায়িত এসব বিশেষায়িত প্রকল্পের সফলতার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত সংস্থা সৃষ্টি হয়েছে যেমন- মহিলা উন্নয়ন অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, পিডিবিএফ ইত্যাদি।
২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে বিআরডিবি সরকারের কাছ থেকে আবর্তক (কৃষি) ঋণ খাতে ৩২০ কোটি টাকা মঞ্জুরী পায় যা বিআরডিবি’র মাঠ পর্যায়ের কর্মকা-- নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৯৮৬-১৯৯৫ মেয়াদে বিআরডিবি, বার্ড, আরডিএ, বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়, জাইকা ও জাপানের কিয়োটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পল্লী উন্নয়নে ‘‘লিংক মডেল’’ নামে একটি টেকসই ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই মডেলের মাধ্যমে গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মীদের মধ্যে Vertical Linkage এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের সেবা গ্রহনকারী গ্রামবাসী ও সেবা প্রদানকারী যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে Horizontal Linkage সৃষ্টি করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়। অংশীদারিত্বমূলক পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (পিআরডিপি) এর লিংক মডেলের মূল লক্ষ্যে হল জনগনের চাহিদা মাফিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য Bottom Up Planning বাস্তবায়ন করা। এ মডেলের মূল হাতিয়ার হল ইউনিয়ন সমন্বয় কমিটির সভা (ইউসিসিএম)। ইউসিসিএম একটি Mini-Parliament যেখানে ইউনিয়ন পর্যায়ের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড জন অংশগ্রহন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়। পিআরডিপি’র সফলতার কারণে বর্তমানে প্রকল্পটি ৩য় পর্যায়ে অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাছাড়া ভিন্ন লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিআরডিবি বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত প্রকল্প বাস্তবায়িত করছে যেমন- দেশের উত্তরাঞ্চলের হতদরিদ্রদের কথা চিন্তা করে ‘‘উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি’’(উদকনিক) প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। অপ্রধান শস্য যেমন- তেল, ডাল ও মসলা জাতীয় শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘‘অপ্রধান শস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ কর্মসূচি’’ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। তাছাড়া গভীর ও অগভীর নলকূপ সচল করার মাধ্যমে সেচ কার্যক্রমকে আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ‘‘সেচ সম্প্রসারণ কর্মসূচি’’ হাতে নেয়া হয়েছে।
এ সকল কাজের স্বীকৃত স্বরূপ ‘‘বাংলাদেশ গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান’’ (BIDS) এর ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় জিডিপিতে বিআরডিবি’র অবদান ১.৯৩% বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরেও বিআরডিবি’র এ কর্মধারা অব্যাহত রয়েছে। এমডিজি, ভিশন-২০৪১ এবং ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে সংগতি রেখে বর্তমানে বিআরডিবি’র ৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস